More
    Homeঅনান্যসাহিত্যিক সমরেশ বসু ও স্ত্রী গৌরি বসুর দারিদ্র ও সাহিত্যের লড়াই

    সাহিত্যিক সমরেশ বসু ও স্ত্রী গৌরি বসুর দারিদ্র ও সাহিত্যের লড়াই

    Today Kolkata:- সাহিত্যিক সমরেশ বসু ও স্ত্রী গৌরি বসুর দারিদ্র ও সাহিত্যের লড়াই। সতেরো বছরের রুগ্ন তরুণ সমরেশ বসু একুশ বছরের গৌরীকে নিয়ে আতপুরের বস্তীতে উঠেছিলেন৷ সম্বল বলতে ছিল একটা হ্যারিকেন,গোটা দুয়েক কাঁথা৷ গৌরীর হাতের সামান্য দু’এক গাছা সোনার চুড়ি,আর যেহেতু তাঁর কণ্ঠে গান ছিল তাই ছিল কিছু স্বল্প বেতনের ছাত্রী৷ বুড়ি ওরফে গৌরী সমরেশকে বলতেন তোমাকে বড় লেখক হতেই হবে৷ চাকরি নিলে তুমি সবসময় লেখা নিয়ে থাকতে পারবে না৷ গৌরী কিন্তু প্রথম থেকে তাঁর স্থির প্রত্যয়ে অটল ছিলেন৷ আতপুরের বস্তিতে তারা সংসার পেতেছিলেন,শুরু হয়েছিল বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রাম৷

     

    সমরেশ বসুর সেই ঘরের কথার সঙ্গে ঘরনীর কথা বলতে হবেই৷ যিনি প্রায় চারটি দশক সমরেশের জীবনে জড়িয়ে ছিলেন৷ আতপুরে ভাড়া করা টালির ঘরের সংসার,সামনে ছিল একফালি বারান্দা৷সেখানে চলত গৌরীর খুন্তি নাড়ানাড়ি৷ সমরেশ জলচৌকির ওপর কাগজপত্র রেখে দোয়াতে ডোবানো কলম দিয়ে লেখেন বাংলা সাহিত্যের চিরায়িত উপন্যাস৷ লেখা শেষ হলে মতামত দিতে হত গৌরীকে৷ লেখক সমরেশ বসুর তৎকালীন অধিকাংশ লেখার প্রথম পাঠিকা বুড়ি৷ প্রথম সমালোচকও তিনি৷ বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক বরণীয় হওয়ার প্রাককালে যাবতীয় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব,রাজনীতির একপেশে ধ্যানধারণা নস্যাৎ করে স্বামীর সৃষ্টিশীলতাকে মান্য করে আশা—ভরসা জুগিয়েছিলেন,লেখকের মনে দোলাচোল কাটিয়ে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিলেন যে নারী তিনি সহধর্মিণী গৌরী বসু৷

     

    সমরেশ বসু জেল খেটেছেন একবছর,যতদিন জেলে ছিলেন ততদিন শ্যালক দেবশঙ্কর, গৌরীকে নিয়ে ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন৷ নিয়ম অনুযায়ী দেখা হত প্রতি বুধবার৷ জেল থেকে সমরেশ বসু বের হলে তাঁর দিন কাটত একপ্রকার নিরন্ন,নিঃস্ব অবস্থায়৷ ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরিতে ১৯৪২ সালে চাকরি পেয়েছিলেন৷ এর আগে কাজ করেছেন পোলট্রি ফার্মে৷ অফিস বলেছিল বণ্ড দিতে,তবে তিনি বণ্ড দেন নি৷ প্রস্তাব পেয়েছিলেন পুলিশ ইনফর্মার হওয়ার,তাহলে চাকরি পাবেন সঙ্গে উপরি৷ ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করলেন৷ ওই প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় সমরেশের চাকরি জীবনের ইতি ঘটে আর জীবন সংগ্রাম শুরু হয়৷

     

    চারিদিকে নিশ্চিদ্র অন্ধকারের মাঝে সিদ্ধান্ত নিলেন লিখেই জীবিকা নির্বাহ করবেন৷ কিন্তু খাবেন কী? সন্তানদের মুখে কি করে দু’মুঠো জোটাবেন৷ একজন সাধারণ মানুষ নাম নারায়ণ মিস্ত্রী৷ তিনি স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে বলেছিলেন সমরেশের যতদিন আয় না হবে ততদিন তাঁর ছেলে-মেয়েদের এক সের দুধ দেবেন সঙ্গে মুড়ি৷ কালকূট সমরেশের পাঠ্য বইয়ের তুলনায় অন্য বই আকর্ষণ করত৷ রেল কোয়ার্টারে তখন বৈদ্যুতিক আলো নেই ৷ বড়দার চোখে ধুলো দিয়ে সে পড়ত শরৎচন্দ্র বা অন্য লেখকের উপন্যাস৷ বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে বড়দা ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন তোর কবে রেজাল্ট বের হবে,সমরেশ সপ্রতিভ ভাবে উত্তর দিয়েছিলেন কাল৷

     

    মন্মথনাথের কণ্ঠে উদ্বেগ, কাল কলকাতায় যাচ্ছি তোর রেজাল্টটা জেনে যেতে পারলে ভাল হত৷ সমরেশ সেদিন বিকেলেই বাইরে থেকে খুশি মনে ফিরে বড়দাকে বলেছিলেন তিনি পাশ করেছেন৷ মন্মথনাথ তাঁর ভাইকে বললেন দেখি,সমরেশ বলেছিলেন প্রগেস রিপোর্ট দেয়নি তবে লিখে এনেছেন৷ প্রত্যেক বিষয়ে পাশ৷ নম্বর খুব ভাল নয়,তিরিশ,চল্লিশ৷ বিয়ে বাড়ি ঘুরে নৈহাটিতে ফিরে খুঁতখুঁতে বড়দা গেলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে৷ সমরেশের প্রগেস রিপোর্ট দেওয়া হল তিনি দেখলেন দু-একটি বিষয় ছাড়া সমরেশ। সব বিষয়ে ফেল করেছেন ৷ একদিন বাড়িতে সমরেশকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ মা-বৌদি কান্নাকাটি করতে থাকেন,বিচলিত বড়দা,অবশেষে তাঁর খোঁজ মিলেছিল এক বন্ধুর বাড়ি মশারির ভেতরে ৷ বন্ধুটি বলল বড়দা মারধর করবেন না ওকে৷ বড়দার উত্তেজনা প্রশমিত হলে এবার ঝোপ বুঝে কোপ ৷

     

    সমরেশ আবদারের সুরে বলেছিলেন আমি আর পড়ব না বড়দা৷ আমার আর পড়া-টড়া হবে না,আমাকে আর্ট স্কুলে ভর্তি করে দাও৷ মম্মথনাথ আশ্বাস দিয়েছিলেন৷ মাঝে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ঢাকা শহরে৷ সেখানে কারখানায় কাজ শিখলেন না বরং বুড়িগঙ্গার জল,রমনার ক্ষেত সমবয়সী বন্ধুদের কাছে গেলে মন জুড়িয়ে যেত৷ প্রায় ষোলো বছর বয়সে সমরেশ নৈহাটিতে ফিরলেন,আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়া হল না৷ মেতে উঠলেন হাতে লেখা পত্রিকা নিয়ে৷ প্রচুর সিগারেট খান,বাঁশী বাজান,গান করেন,ছবি আঁকেন,অভিনয় করেন৷ ধিক্কার,নিন্দা,কটুক্তির মাঝখান দিয়ে সে এক দুরন্ত তরুণ৷ জণ্ডিস বাসা বেঁধেছিল সমরেশের শরীরেও৷ মুমূর্ষ হওয়ার আগে সে দেবশঙ্করদের বাড়িতে খুব যাতয়াত করত৷ বড়দি গৌরীও (ডাকনাম বুড়ি) সমরেশকে খুব স্নেহ করতেন৷ নিন্মবিত্ত সংসারের পুঞ্জীভূত গ্ল্যানি ও নৈরাশ্য তাঁকে ক্রমশ অস্থির করে তুলেছিল,

    আরও পড়ুন – Sagardighi তৃণমূলের হাত ছাড়লেও কংগ্রেসের ‘হাত’ ধরল সাগরদিঘী, কোন সূত্রে অধীরকে ধন্যবাদ জানালেন মমতা ?

    এমন সময় বছর সতেরোর এক মুমূর্ষ তরুণ কে তিনি কার্যত স্বেচ্ছায় বাঁচিয়ে তোলার দায় স্বীকার করে এগিয়ে এসেছিলেন৷ গৌরীর পরের বোনের বিয়ে হয়ছিল উত্তরপ্রদেশের গাজীপুরে৷ তখন গৌরী কিছু গয়না বিক্রী করলেন টাকা সংগ্রহ করে ছোট ভাই দেবশঙ্করকে সঙ্গে দিয়ে সমরেশকে সেখানে পাঠালেন স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য৷ জল হাওয়ার গুণে সমরেশের ম্যালেরিয়া,জণ্ডিস সব সেরে গেল৷ ততদিনে মনের দিক থেকে কাছাকাছি এসেছেন তারা৷ গৌরী মন্মথনাথের স্ত্রী’র সঙ্গে আলাপ করতেন,গান শোনাতেন,সমরেশদের বাসায় মাঝে-মধ্যে আসতেন কিন্তু গৌরীর প্রতি মন্মথনাথের ‘বিতৃষ্ণাভাব’ থাকায় তাঁর পক্ষে তখন ওদের পরিবারে গৃহীত হবার সম্ভাবনা থাকল না৷ সমরেশের আবাল্য সুহৃদের সাথে গৌরীর আলাপ ছিল আগেই৷

     

    তিনি জানতেন সমরেশের সহায় সম্বলহীনতার কথা,বেকার জীবনের কথা,মৃত্যু কিছুদিন আগে তাঁর শিয়রে হানা দিয়েছিল সেকথাও অজানা নয়৷ তিনি আরও জানতেন গৌরীকে বিবাহ করলে সমরেশ কে গুরুতর পারিবারিক সংকটে পড়তে হবে,স্বজন—পরিত্যক্ত হতে হবে৷ স্বভাবত সমরেশ নিজেও সেইসময় বেশ উদভ্রান্ত হয়েছিলেন,বেঁচে গেলেন একদিন একটা মিলিটারি ট্রাকের ধাক্কা থেকে৷ বন্ধুটি ভর্ৎসনা করে বলেছিল এক্ষুনি তো হয়ে যাচ্ছিলি৷ উদভ্রান্ত সমরেশ জবাব দিয়েছিলেন হয়ে গেলে ভাল হত৷ তবুও সমরেশ নিজেকে গৌরীর জীবন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার কথা ভাবেন নি৷কারণ ইতিপূর্বে তিনি যেসব মেয়েদের সাথে মিশেছেন তাঁর কিছুটা অকালপক্কতা তাদের চোখে তাঁকে প্রেমিক বানালেও গৌরীর মত একটা স্নেহশীল হৃদয়,সংসারপরায়ণা নারীর সাথে ইতিপূর্বে পরিচয় হয় নি৷

     

    তিনি বুঝেছিলেন গৌরীর ভালবাসা,স্নেহের মধ্যে ছিল কিভাবে সমরেশকে বড় করে তোলা যায়,শরীরের দিক থেকে সুস্থ করা যায়৷ তিনি ছিলেন তাঁর ছবি আঁকার একজন সমঝদার৷ সমরেশ তখন যেসব গল্প লিখতেন তিনি সেগুলো পড়তে ভালবাসতেন৷ তাই সমরেশ,গৌরীর সম্পর্ক ক্রমশ গভীর হল,অচ্ছেদ্য হল,সমাজের কোনও কথা চিন্তা না করে ওরা দুজন শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ওরা নৈহাটি ছেড়ে যাবেন৷ একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে নৈহাটির রথতলা থেকে গৌরীকে তুলে নিয়ে এলেন সমরেশ৷

     

    দুঃসহ মানসিক টেনশনে ঘোড়ার গাড়িতে সে গেল অজ্ঞান হয়ে৷ সমরেশ ঘোড়ার গাড়িটা একটা কলের কাছে থামিয়ে সেখান থেকে জল এনে গৌরীর মাথায় দিলেন,ক্রমশ সে স্বাভাবিক হল৷ আতপুরের একটা বস্তিতে গিয়ে ওঁরা উঠলেন৷ সমরেশ-গৌরী আতাপুরের বস্তিতে সংসার পাতলেন৷ শুরু হল বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রাম৷তারপর সেই সমরেশ বসু হয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী,সেই ইতিহাস অজানা নেই আমাদের কারও৷ গ্রন্থঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার,কালকূট সমরেশ,ডঃ নিতাই বসু

    RELATED ARTICLES

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    - Advertisment -

    Most Popular

    Recent Comments